রক্তাত্ত পলাশ
-সুমন ভৌমিক।
"আমি স্কুলে যাই" ইংরেজিতে কি হবে? "I go to school "
বোনের কানটা ধরতেই আরে আরে "আমি ভাত খাই" "l eat rice"
তাহলে "আমি স্কুলে যাই" " l go school " ভুলটা কোথায় বলিলাম।
তাহলে "আমি স্কুলে যাই" " l go school " ভুলটা কোথায় বলিলাম।
হঠাৎ বাহির হইতে আওয়াজ আসিল -"অনিকেট মিশ্র বাড়ি আছ নাকি।" অনিকেটের বোন অনিতা বলিয়া উঠিল বাড়িতে আছেন কিন্তু তিনি এখন বোনকে মারধরে ব্যস্ত। অনিকেটের মা চিঠি লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। অনিকেট বোনের কান থেকে হাত সরাইতেই অনিতা মায়ের কাছ থেকে চিঠি লইয়া দিল দৌড়। অনিকেটও বোনের পিছু নিতে বাধ্য হইল । তার বোন একনাগাড়ে ছুটিয়া পৌঁছিয়া গেল বটতলায়। সবুজ ঘাসে মোড়া দিগন্তহীন মাঠ দূরে পলাশের গাছ, কৃষ্ণচূড়ার ফুল গুলো বাতাসে একটু বেশিই দোল খাচ্ছে, মাথার ওপর বিস্তৃত খোলা নীল আকাশটা অস্তগামী সূর্যের রক্তিম বর্ণ ধারন করিয়া লাল হইয়া উঠিয়াছে। ধান খেত গুলো সূর্যের লাল আভায় একটু
অনিকেট উপস্থিত হইতেই অনিতা মাথা নিচু করিয়া অনিকেটকে চিঠিটা হস্তান্তরিত করিল। অনিকেট খাম খুলিয়া চিঠিতে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। হঠাৎ তার বোন আবার চিঠিটা ছড়াইয়া লইল। অনিকেট বলিল কি লেখা আছে পড়। সে পড়িতে শুরু করিল-
"শ্রী অনিকেট মিশ্র"
কিছুক্ষণ থামিয়া বলিল "ও এটা তোর চাকরির চিঠি। আচ্ছা তুই চাকরি পেলে আমার জন্য কি আনবি? " "তোর কি চাই বল " অনিকেট বলিল। " একটা লাল শাড়ি, গোলাপি পুতুল, এক বাক্স নেলপলিশ, অনেক গল্পের বই আর ৩৬৫ টা পোস্টকার্ড এখানে বসে তোকে প্রত্যেক দিন চিঠি লিখিব।" অনিকেট হাসিয়া বলিল "আচ্ছা সব আনিব বাড়ি চল সন্ধ্যা হইয়াছে।"
পরের দিনই যথা সময়ে অনিকেট রওনা হয়ে গেলো।
"May I come in sir"
"Yes come in,
name please"
"Aniket Misra sir"
"অনিকেট মিশ্র আমাদের কোম্পানির তরফ থেকে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তুমি ১২ তলাতে ৫৩৪ নম্বর রুমে চলে যাও তোমাকে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। " বস বললেন।
অনিকেট তার কোম্পানিকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করে। ঠিক হনুমান যেভাবে লক্ষণের প্রান রক্ষা করেছিল, অনিকেটও পাহাড় সম সমস্যা নিজ স্কন্ধ এ তুলিয়া সমস্ত সমস্যার সমাধান করিয়া কোম্পানিকে রক্ষা করে। তাতে সে বসের অনেক আস্থা লাভ করিয়াছে। একবার শ্রেষ্ঠতম এর পুরষ্কারও লাভ করিয়াছে। কিন্তু সমস্যা আর ব্যস্ততা তাকে এমন বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছে যে সে আর তাহা হইতে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না। এ জীবনের ব্যস্ততার যেন অন্ত নেই যা লক্ষ হীন চাহিদার মতোই অতলস্পর্শী এ জীবন বেঁচে থাকার আশ্বাস দেয় না, জীবন গড়ার শপথও নেয় না।
প্রায় ছয় মাস হইতে চলিল সে একবারও তার মা আর বোনের কাছে যাইতে পারিল না। সে এখনও তার বোনকে ৩৬৫ টি পোষ্টকার্ড কিনিয়া দিতে পারিল না কিন্তু ইতিমধ্যেই তার বোন তাকে ৫ টি চিঠি লিখিয়া পাঠাইয়াছে তার আসিবার অনুরোধে। সে নাকি অনেক আম লিচু সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে। প্রত্যেক বারই অনিকেট আসিবে বলিয়া আশ্বাস দিয়াছে। অনিকেট একবার তাহাকে এই শহরে নিয়ে আসার কথাও বলিয়াছে। যদিও অনিতা আসিতে চাইছিল না , কিন্তু মেট্রোরেল কিভাবে মাটির নীচে চলে তাহা দেখিবার জন্য সে একবার আসিবে।
সূর্য পশ্চিম। আকাশে । অস্তগামী। চারিদিক লাল আভায় আবৃত্ত প্রকান্ড বট গাছটা শাখা মেলে মায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে নিচে দাঁড়িয়ে অনিতা সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে, অনিকেট বোনের কাছ থেকে চিঠিটা নিতে যায়, হঠাৎ, হাতটা থেমে যায় ঘড়িতে এর্লাম বাজতে শুরু করে, আতঙ্কে অনিতা বলিয়া চিৎকার করিয়া ওঠে অনিকেট, স্বপ্নটা ভাঙিয়া যায়।
প্রত্যেক দিনের মতোই অনিকেট স্নান করে শুট বুট পরে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে একবার আকাশটাকে দেখার চেষ্টা করে, হায় কোথায় আকাশ ইমারত গুলো তাকে ঘিরিয়া বন্দী বানাইয়াছে। এখানে কোথায় সেই সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠ, বসন্তের কোকিলের ডাক, গ্রীষ্মের দক্ষিণা বাতাস, দূরে গাছ ভরা ওই লাল পলাশ, কোথায়ই বা শরতের কাশে কাশে ভরা মাঠ, পূর্ণিমা রাতের মোহময়ী চাঁদ, কোথায়ই বা কৃষ্ণচূড়ার রঙ, দিগন্তের রামধনু।
অফিসে পৌঁছে অনিকেট অফিসের কাজ শুরু করে। হঠাৎ বস এসে বলিল "অনিকেট তোমার ফাইলটা সম্পূর্ণ হইয়াছে?" অনিকেট "হ্যাঁ " বলিল। ভালো করিয়া কিছুক্ষন ফাইলটা দেখিয়া বস মন্তব্য করিলেন "এবারের প্রথম পুরস্কারটা তুমিই পাবে বলিয়াই মনে হইতেছে।" "আচ্ছা তোমার মা আর বোন কি এখানেই থাকেন? " অনিকেট জবাবে "না" বলিল। বস বিস্মিত হইয়া বলিলেন "তুমি এখনও একবারও বাড়ি যাওনি।" অনিকেট মাথা নত করিয়া উত্তর দিল "না স্যার কাজের চাপে যাওয়া হয়েছে ওঠেনি।" "বল কি অনিকেট, আমি তোমাকে ১৫ দিনের ছুটি দিলাম যাও বাড়ি হইতে ঘুরিয়া আস" বস অনিকেটকে আদেশ দিলেন।
অনিকেটের আনন্দের বাঁধ ভাঙিয়া পড়ে। সে বাজার হইতে বোনের কাঙ্ক্ষিত সমস্ত দ্রব্য কিনিয়া লয়। যথা সময়ে ট্রেন এসে উপস্থিত। কামরাটা সম্পূর্ণ খালি। ট্রেন চলিতে শুরু করে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা।
অনিকেটকে দেখেই খুশিতে ভেঙে পড়ে বোন অনিতা। ছুটে এসে অনিকেটের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নেয় সে। অনিকেটকে প্রশ্ন করে " সবগুলো এনেছিস তো? " "দেখি, বাঃ শাড়িটা বেশ তো, এই তো পুতুল, কি কি গল্পের বই আছে দেখি - শরৎচন্দ্র সমগ্র, সঞ্চয়িতা, ছোটদের মহাভারত। " আর হাসি মুখে অনিতা বলে "আমি তোর জন্য একটা রামধনু রঙের সোয়েটার বুনেছি। তোকে দেখাব চল চল। " হঠাৎ কড় কড় শব্দে ঘুম ভাঙিয়া যায় অনিকেটকের। ট্রেন চলিতেছে। বেশ মেঘ করিয়াছে বাহিরে। ঝির ঝির করিয়া বৃষ্টিও পড়িতেছে। বাংলার ভিজে মাটির গন্ধ অনিকেট অনুভব করিল। অনিকেট উঠিয়া পড়িল। ট্রেনের দরজা হাত বাড়াইল টুপ টুপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতে থাকিল। অনিকেটের এক অদ্ভুত শান্তি অনুভূত হইতে লাগিল। আস্তে আস্তে সে মুখমন্ডল বাহির করিল। টুপ টুপ বৃষ্টিতে অনিকেটের মুখমন্ডল ভিজিয়ে যাইতে লাগিল। এক মুহূর্তে বাংলার রূপটা তার চোখের সামনে স্বপ্নের মতো ভাসিয়া উঠিল।
সহসা এক ট্রেনের খুঁটি সজোরে অনিকেটের বৃষ্টি ভেজা মুখমন্ডলে আঘাত করিল। এক তীব্র যন্ত্রণা তাহাকে গ্রাস করিল। আস্তে আস্তে শান্ত দেহটি ট্রেন হইতে পড়িয়া গেল। ট্রেনটা তখনও সগতিতে তীব্র হুইসেল দিতে দিতে চলিতেছে তার গন্তব্যের পানে। অনিকেটের দেহটি রেলপাতে আঘাত করিয়া রক্তাক্ত হইয়া উঠিল। ভেজা বৃষ্টিতে অনিকেটের মুখ লাল হইয়া উঠিল। আকাশে মেঘ গুলো তখনও শরতের কাশের মতোই দোল খাইতেছিল লাল বর্ণের রক্তিম সূর্যটা একবার বাংলার লাল পলাশের মতোই উঁকি দিল। অনিকেটের মুখমন্ডল বাংলার লাল পলাশের মতোই রক্তিম বর্ণ ধারন করিল। মুখে ক্ষীণ হাসি ও বাংলার স্বপ্ন দেখানো দুটি চোখ বৃক্ষ হইতে ঝরে পড়া রক্তিম পলাশের মতোই স্থির, অপলক হইয়া রহিল।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment