সাঁঝবেলা
- সুমন ভৌমিক।
মনে কি পড়ে সেই ছোট্ট দুটি হাত
মনে কি পড়ে ওই দুধে আলতা পা
মনে কি পড়ে ক্লাস টু এর ওই ছোট্ট বালিকাটিকে
মহালয়ার ভোরের দুর্গা, ওই ছোট্ট মেয়েটিকে।
আমার তো মনে পড়ে, সেই পুতুল খেলার ঘর,
সেই ছোট্ট মহীষাসুর,
মনে পড়ে না বোধ হয়,
আমারও হয়তো মনে পড়ত না-
আজ হঠাৎ কলকাতার ওই ছোট্ট গলিটাতে
সেই পুরোনো ছেলেটিকে দেখিলাম হাঁটিতে হাঁটিতে।
দেখিবা মাত্র স্থির রাজপথে স্থির হইয়া গেল. চলমান পদক্ষেপ,
মুহূর্তে ভাবিলাম- ডাকিব তোকে,
করিব আলাপ,
নাঃ, পারিলাম না ডাকিতে, মাত্র একটিবার, করিয়া আক্ষেপ।
তুই চলে গেলি, হালকা শার্ট, নীল প্যান্ট, চকচকে বুট জুতো,
আমি শুধু রহিলাম দাঁড়িয়ে, পাঁচ মিনিটের রাজপথে,
ঘন্টা খানেক মতো।
ভেবেছিলাম করিব প্রকাশ, মনের ভাষাটিকে,
মুখের ভাষা দিয়ে,
পারিলাম নাঃ, শুরু করিলাম চলিতে পথ,
একমুঠো স্বপ্ন নিয়ে। মনের মানসপটে স্পষ্ট ভাসিয়া উঠিল
ছোট্ট মহিষাসুরটির মুখ,
উঠিল ভাসিয়া, আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব,
হারিয়ে যাওয়া কত সুখ দুখ।
মনে কি পড়ে- সেই আম গাছ, গ্রীষ্মের দুপুর
মনে কি পড়ে- সেই শরতের কাশ, বসন্তের কৃষ্ণচূড়া
মনে কি পড়ে- লিচু চুরি, পুকুরে স্নান
মনে কি পড়ে- ভুলে যাওয়া কত মান অভিমান।
মনে কি আছে- সেই বার, যেই বার আমি-
করিয়া রাগ, মুখ লাল, বসিয়া বটতলে
তুই নিয়ে এলি,বানানো খেজুর পাতার পুতুল
তোর পুতুল দেখিয়া, আমি মুচকি হাসি,
গেলো রাগ সব জলে।
মনে পড়ে না বোধ হয়,
শুধু আমিই মনে করে গেলাম-
জানিস আমি কত অপেক্ষায় ছিলাম,
এক রাঙা সন্ধ্যায়, রাঙা গোলাপ হাতে
তুই থাকবি আমার অপেক্ষায়।
কত রঙিণ বসন্ত, শ্বেত শুভ্র শরৎ গিয়েছে চলে
আমি যেন আজও তোর অপেক্ষায়,সেই বটতলে।
তারপর আজ, অনেক বছর পরে
চাকরি শেষে, সুদূর শহর ছেড়ে এসেছি আমার গ্রামে,
জীবনের ৬৫ টি বসন্ত গিয়েছে পেরিয়ে,
তুইও ৬৬ টি শরৎ, কাটিয়ে নিয়েছিস কোনক্রমে।
আজ হঠাৎ চোখে পড়ল,
তোর দেওয়া সেই খেজুর পাতার পুতুল বাক্সের কোন থেকে ওটাকে বের করলাম,
যত্ন করে হাতে নিলাম,
টপ করে একটা শব্দ ,
এক ফোঁটা জল, পুতুলের কপালে-
ছলছলে চোখ, লুকোতে চায় আঁখি জল,
পুতুল বলল যেন-
'চল, বেড়িয়ে আসি চল।'
গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকি
কত শত পরিবর্তন নজরে দেখি।
কমে গেছে জুঁই শিউলির মেলা অনেকটা,
ভালোই বোঝা যায়, গ্রাম শহরের ফারাকটা।
তবুও প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বৃক্ষ বট,
নির্জন, নির্মল, আবেগপ্রবন কত স্মৃতি উজ্জ্বল- করিয়াছে তোমার তট।
আজও আমি আশ্রয় নিই, আঁখি ভরা জলে
নিমলিত নয়নে তোমারি চরন তলে।
হঠাৎ থমকে দাড়াই, বিষ্মিত নয়নে দেখি,
তোমারি পদতলে,
যা দেখি সবই কি সত্য, নাকি মনের ভুলে।
আজ তিরিশ বছর পরে,
সেই পুরোনো তোমাকে দেখি নতুন আবরনে
এক মাথা সাদা চুলে,
গাল দুটিও গিয়েছে ঝুলে,
ছোট ছোট স্বপ্ন দেখানো দুটি চোখ
সদ্য প্রস্ফুটিত গন্ধরাজের মতো মুখ।
আস্তে আস্তে গিয়ে বসলাম তার পাশে
উদার নয়নে সে যেন কি বলতে চায় এই সাঁঝে,
হঠাৎ বের করি বর্ষসেরা ছোট্ট সেই মুকুল
'দেখো তোমার সেই খেজুর পাতার পুতুল।'
চাহিয়া অস্তগামী সূর্য পানে,
আর না রহিয়া চুপ,
শুধু একবার বলিল-
'জানো, আমি তোমায় ভালোবাসিতাম খুব।'
ধরিলাম তাহার হাত,
বলিলাম-
'আমা পানে চাহ একবার' শুধাইলাম তারে-
'ভালোবাসিতে কি শুধু আগে, ভালোবাস না কি আর।'
চাহিয়া আমা পানে, বলিল শিশুর মতো-
'বাসি ত।'
শেষবারের মতো ডাকিল এক কোকিল বারকয়েক,
কৃষ্ণচূড়ার শাখা হইতে, কৃষ্ণচূড়া ঝরিল গুটিকতেক।
নাঃ, সে দেরি করে নাই,
আজ খুশিতে ভেঙেছে বাঁধ,
পুব আকাশে উঠেছে তাই
পুরানো, কিন্তু উজ্জ্বল এক চাঁদ।